কক্সবাজারের ঈদগাঁও–ঈদগড়–বাইশারী সড়কটি দীর্ঘবছর ধরে অনিরাপদ। চলাচলে লোকজন চরম আতংক বোধ করছেন। হিমছড়ি ও পানেরছড়া ঢালায় সেনাবাহিনী বা বিজিবির স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন দাবী।
পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে কেউ যদি যাত্রা করেন, তার ভেতর কাপুনি শুরু হয়ে যায়। কারণ, এ সড়কের প্রতিটি বাঁকই লুকিয়ে রেখেছে ভয়-অপহরণ বা ডাকাতির। ১৫ বছরে সড়কটিতে ঘটেছে তিন শতাধিক অপহরণসহ ৫ শতাধিকের মতো ডাকাতির ঘটনা। ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই মুক্তিপণ দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। কেউ গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন, কেউ চিরজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। ফলে জনপদের প্রতিটি পরিবারই বয়ে বেড়াচ্ছে আতঙ্কের বোঝা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের টহল বা উপস্থিতি নেই বললেই চলে। স্বাধীনতার পর থেকে এ সড়ক অনিরাপদ রয়ে গেছে। অথচ প্রতিদিন হাজারো মানুষ জীবিকার টানে এই পথে চলাচল করেন। তারা জানেন না-কোন মুহূর্তে, কোথায় কে ডাকাতের কবলে পড়বেন । এক ভুক্তভোগীর মতে,এখানে জীবনের দাম মুক্তি পণের টাকার সমান। টাকা দিলে ফিরে আসা যায়, না দিলে জীবনটা আর থাকে না।’
ঈদগড় বাজার কমিটির সভাপতিসহ স্থানীয়দের মতে, ‘এই সড়ক দিয়ে যাতায়াত মানেই বুক ধড়ফড়ানি- কখন যে কোথায় দস্যুরা গতিরোধ করবে, কে অপহৃত হবে বা কে প্রাণ হারাবে- এ নিয়ে প্রতিটি পরিবার বেঁচে আছে চরম উদ্বেগে। সন্ধ্যা নামলেই এই পথ অচল হয়ে পড়ে। মানুষ যাতায়াত বন্ধ করে দেয়, ঘরে ঘরে নেমে আসে শঙ্কা।’
দিন-রাত নির্বিশেষে ডাকাতরা যাত্রীদের আটকে সর্বস্ব লুট করছে। আবার সুযোগ বুঝে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি জঙ্গলে। সেখানে দিনের পর দিন আটকে রেখে পরিবারের কাছে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করছে। টাকা না পেলে চলে অমানুষিক নির্যাতন।
এই পরিস্থিতিতে ঈদগাঁও, ঈদগড় ও বাইশারী-৩ ইউনিয়নের প্রায় ১ লাখ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের দাবি, অবিলম্বে হিমছড়ি ও পানেরছড়া ঢালায় সেনাবাহিনী বা বিজিবির স্থায়ী ক্যাম্প বসাতে হবে। ঈদগাঁও–ঈদগড় সড়কের ঢালাগুলোতে জন্মলগ্ন থেকেই চলছে ডাকাতি ও অপহরণের মতো অপরাধ। স্থানীয়রা বলেন, ‘যুগের পর যুগ ধরে একই চিত্র। বরং সময়ের সঙ্গে অপরাধ বেড়েছে।’
২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বরের একটি ঘটনা স্থানীয়দের স্মৃতিতে গেঁথে আছে। বনী আমিন ও হাজী আবুবকর সিদ্দিককে অপহরণ করা হয়। তিন দিন জিম্মি রাখার পর ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে তাঁদের মুক্তি পায় পরিবার। এরপর থেকে অপহরণ যেন নিয়মিত ব্যবসায় রূপ নেয়।
২০১৬ সালে ঈদগড় চরপাড়ার লেদু মিয়া অপহরণের শিকার হন। ৪৮ ঘণ্টা বন্দী থাকার পর ২ লাখ ২০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান। একই বছর নুরুল আমিনকেও অপহরণ করে ডাকাতরা। মুক্তিপণ দিয়ে তাঁকেও ছাড়িয়ে আনা হয়।
শুধু অপহরণ নয়, ডাকাতের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। ২০২০ সালে ঈদগড় চরপাড়ার জনি দে রাজ নামের এক কিশোর শিল্পী সড়কে ডাকাতের গুলিতে নিহত হন। সে ঈদগাঁও ফরিদ আহমদ ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিল। একই ঘটনায় দিনমজুর কালু প্রাণ হারান।
২০১৯ সালে চরপাড়া এলাকার নুরুল হুদাকে অপহরণ করে ডাকাতরা। মুক্তিপণ হিসেবে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পান তিনি। ২০২২ সালের আগস্টে বাইশারীর রাশেদুল ইসলামসহ দুজনকে সড়ক থেকে অপহরণ করা হয়। ৩৬ ঘণ্টা পর ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে তাঁদের ফেরত পান পরিবার।
২০২৫ সালের শুরুতে মসজিদের ইমাম মিজানুর রহমানকে অপহরণ করে ডাকাতরা। সকাল ৭টার দিকে ঈদগড় থেকে ঈদগাঁও যাওয়ার পথে তাঁকে তুলে নেয়া হয়। ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ২৪ ঘণ্টা পর তাঁকে উদ্ধার করা হয়। একই বছর ঈদগড় বাজারের ব্যবসায়ী জাগের হোসেনও অপহৃত হন। মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান তিনিও।
ডাকাতরা শুধু সাধারণ মানুষ নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও রেহাই দেয়নি। স্থানীয়রা জানান, পানেরছড়া ঢালায় দায়িত্বরত অবস্থায় ডাকাতের গুলিতে নিহত হন ঈদগড় পুলিশ ক্যাম্পের নায়ক শুসময় চাকমা। এই হত্যার পরও দৃশ্যপট বদলায়নি।
অসহায় মানুষরা নানাসময়ে সভা, সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছেন। সময় বেঁধে দিয়ে সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সড়কে চলাচলের দাবি তুলেছেন। এ সময়ে পুলিশ টহল দিলেও কার্যত ফল হয়নি। দিন-রাত, যখন তখন আবারও ডাকাতি-অপহরণ ঘটেছে। গত বছরের জুলাইয়ে সাততারা এলাকায় চারটি সিএনজি ও একটি ব্রয়লার মুরগির গাড়ি ডাকাতির শিকার হয়।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের মতে,, ‘হিমছড়ি ঢালার কাছে পুলিশ দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে নিরাপদ মনে করেছিলাম। কিন্তু কিছুদূর যেতেই ডাকাতরা আমাদের ঘিরে ফেলে।’
স্থানীয়দের মতে, দীর্ঘদিনের এই অপহরণ-ডাকাতির কবল থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় সেনাবাহিনী বা বিজিবির স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন। এর আগেও পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার বা সেনা ক্যান্টনমেন্ট করার পরিকল্পনার কথা শোনা গেলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
ঈদগড়ের এক প্রবীণ শিক্ষকের মতে, ‘আমরা যুগের পর যুগ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। সন্তানরা স্কুলে গেলে ফেরত আসবে কি না, এটাই আমাদের বড় ভয়। এত মৃত্যু, এত অপহরণের পরও সরকার কেন স্থায়ী সমাধান দিচ্ছে না, তা আমরা বুঝি না।’
সমাজকর্মী বনী আমিনের মতে, ‘স্বাধীনতার পর থেকেই ঈদগাঁও-ঈদগড় সড়ক অনিরাপদ। অথচ এত বছরেও প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এ সড়ক যেন ডাকাত ও অপহরণকারীদের স্বর্গরাজ্য। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ। কোন অপহরণ বা ডাকাতির ঘটনা ঘটলে থানায় সহযোগিতা পাওয়া যায়না।
এ বিষয়ে ঈদগাঁও থানার ওসির মতে, ‘আমরা পুলিশের টহল জোরদার করেছি। আমার থানায় যে কোন সেবা দিতে আমরা প্রস্তুত।’ অন্যদিকে রামু থানার ওসির মতে, ‘ঈদগড়ের জনগণকে সেবা দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।